আজ (উইকিপিডিয়াতে ২২, জুলাই) কুমারখালীর গর্বের একজন ব্যাক্তিত্ব কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের জন্মদিন। বাংলা সংবাদপত্র প্রসঙ্গে আলোচনা করলে কুমারখালীর নাম ওঠে সর্বাগ্রে। কেননা সংবাদপত্র প্রকাশের জন্য কুমারখালী ইতিহাসে একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। আর এর মূলে রয়েছেন সাহিত্যের সাংবাদিক শ্রী হরিনাথ মজুমদার ওরফে কাঙাল হরিনাথ। বাংলাদেশে বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশনার জগতে তিনি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপনকারীর দাবিদার। কাঙাল হরিনাথ, হরিনাথ মজুমদার ২০ জুলাই,: ১৮৩৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন। মৃত্যু: ১৬ এপ্রিল, ১৮৯৬। বাংলা লোকসংস্কৃতির অন্যতম ধারক ও বাহক হিসেবে পরিচিত বাউল সঙ্গীতের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন। তিনি সর্বসমক্ষে ফকির চাঁদ বাউল নামেও পরিচিত ছিলেন। তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের নদীয়া জেলার কুমারখালী (বর্তমান বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলা) জন্মগ্রহণ করেন। খুব ছোটবেলায় তার পিতা-মাতা লোকান্তরিত হন। তার পিতার নাম হরচন্দ্র মজুমদার। অত্যাচারিত, অসহায়, নিষ্পেষিত কৃষক-সম্প্রদায়কে রক্ষার হাতিয়ারস্বরূপ সাংবাদিকতাকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন হরিনাথ মজুমদার। অল্পশিক্ষা নিয়েই তিনি দারিদ্র্য ও সচেতনতা বিষয়ক লেখনি সংবাদপত্রে প্রকাশ করতেন। প্রথমে সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় লিখতেন। প্রাচীন সংবাদপত্র হিসেবে বিবেচিত সংবাদ প্রভাকর পত্রিকাটি এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
পরবর্তীকালে ১৮৬৩ সালের এপ্রিল মাসে কুমারখালী থেকে গ্রামবার্তা প্রকাশিকা নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন তিনি। মাসিক এ পত্রিকাটি কালক্রমে প্রথমে পাক্ষিক ও সবশেষে এক পয়সা মূল্যমানের সাপ্তাহিকী পত্রিকায় রূপান্তরিত হয়। এতে সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ক প্রবন্ধ নিয়মিত মুদ্রিত হতো। নিজগ্রামের লোকের উপর জোর-জুলুম, দুঃখ-অভাবের ঘটনা সাধারণের সামনে আনার উপলক্ষ্যে তিনি প্রবন্ধ লেখা আরম্ভ করেন কবি ইশ্বরচন্দ্রের ‘সংবাদ প্রভাকর’-এ। কবির উপদেশে তার (কাঙাল) প্রবন্ধের ভুল-ত্রুটি সংশোধন করে প্রকাশ করা হতো। তারপর নিজ উদ্যোগে গ্রাম-হিতৈষণার আদর্শ নিয়ে ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ প্রকাশ করেন। তা ‘কলকাতার গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্নর যন্ত্রে মুদ্রিত ও কুমারখালী থেকে প্রকাশিত হতো।চার-ফর্মার এই মাসিক পত্রিকার মূল্য ছিল পাঁচ আনা। শেষে এক পয়সার সাপ্তাহিকী পত্রিকায় রূপান্তরিত হয়। এছাড়াও, কুসীদজীবী ও নীলকর সাহেবদের শোষণের কেচ্ছা-কাহিনীও প্রকাশিত হতো। ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট ও দেশী জমিদারদের অব্যাহত হুমকিও তাকে এ-কাজ করা থেকে বিরত রাখতে পারেনি।
নিঃস্ব কাঙ্গাল হরিনাথ সারাজীবনে সচ্ছলতার মুখ দেখতে না পেলেও ১৮৭৩ সালে কুমারখালীর নিজ গ্রামেই গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকাটির নিজস্ব ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। ১৮ বছর রাজশাহীর রাণী স্বর্ণকুমারী দেবী’র অর্থ আনুকূল্যে কাগজ চালানোর পর আর্থিক কারণে ও সরকারের মুদ্রণ শাসনের ব্যবস্থার জন্য পত্রিকাটিকে বন্ধ করে দিতে হয়।
কাঙালহরিনাথ মজুমদার ‘গ্রামবার্তা’ প্রকাশের ক্ষেত্রে যে নির্ভিক কলম যোদ্ধার পরিচয় দিয়েছিলেন তা হয়েছিল মূলত সাহসী ও দৃঢ় চরিত্রের জন্যই। তিনি ‘গ্রামবার্তা’ এম এন প্রেসকে কেন্দ্র করে কুমারখালীতে একটি সাহিত্য পরিমন্ডল গড়ে তোলেন। যা পরবর্তীতে অবিভক্ত বাংলায় এক বিরাট অবদান রাখে। গ্রামবার্তা প্রকাশিকায় তৎকালীন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের খ্যাতনামা পন্ডিতরা লিখতেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিভিন্ন বিষয়ক প্রবন্ধ, ছড়া ইত্যাদিও এতে প্রকাশিত হত। প্রখ্যাত মুসলিম লেখক মীর মশাররফ হোসেনের সাহিত্যচর্চার হাতেখড়িও হয় এ পত্রিকার মাধ্যমে। তিনি গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকার একজন মফস্বল সাংবাদিক ছিলেন। ছাত্র থাকাকালীন অবস্থায় এ পত্রিকায় তার অনেক লেখা প্রকাশিত হয়। এ পত্রিকার মাধ্যমেই তিনি পরবর্তীকালে মুসলমান রচিত আধুনিক বাংলা সাহিত্যে সমন্বয়ধর্মী প্রবর্তক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। দিনলিপি ডাইরিতে কাঙালহরিনাথ লিখেছেন আমিই লেখক, আমিই সম্পাদক, আমিই ছাপাকারী, আমিই বিক্রেতা এবং আমিই পত্রিকার প্রধান কর্তা। এই প্রেসের মাধ্যমে তিনি ১০/১২ জনের কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা করেছিলেন।
কাঙাল হরিনাথের ‘শখের বাউল’ ১৮৮০ সালের কথা। তখন গ্রীষ্মকাল। কাঙাল হরিনাথের জীবনে এক অভাবনীয় মুহূর্ত ছিল সেটা। তিনি লালনের গান শুনে মোহিত হয়ে পড়লেন। ভাবলেন নিজেও একটা বাউল গানের দল গড়বেন। তাঁর গ্রামবার্তা-প্রেসে কাজ করার সময় পাশে পেলেন অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় ও জলধর সেনকে। ব্যস, জমে গেল সাঙ্গ। পাশে পণ্ডিত প্রসন্ন কুমার বললেন, ‘নতুন করে গান তৈরি করতে হবে।’ শুরু হলো কাজ। সে এক অপার্থিব দৃশ্য ছিল বটে। নকল বাউল গানের দল। গানের সঙ্গে ছিল নৃত্য। জলধর সেন সেই বর্ণনা দিয়েছিলেন চমৎকার করে, ‘দেখিতেছি একদল ফকির; সকলেরই আলখাল্লা পরা, কাহারও মুখে কৃত্রিম দাড়ি, কাহারও মাথায় কৃত্রিম বাবরি চুল, সকলেরই নগ্ন পদ।’ এই দল দেখেছিলেন প্রাণকৃষ্ণ অধিকারী। তাঁর বর্ণনা থেকে পাওয়া যায়, ‘খেলকা, চুল, দাড়ি, টুপি ব্যবহার এবং কাহার কাহার পায়ে নূপুরও থাকিত। বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে ডুগি, খোমকা, খুঞ্জরী, একতারা প্রভৃতি ফকিরের সাজে তাহারা বাহির হইত। ফিকিরচাঁদ ফকিরের দল দেখিয়া শেষে গ্রামে গ্রামে অনেক দল সৃষ্টি হইল।’ তবে এ কথা কিন্তু সত্যি লালন যা পারেননি, সেই কাজ করতে পেরেছিলেন তাঁরা। তাঁরা গানকে পৌঁছে দিয়েছিলেন বাংলার বিস্তৃত সীমানায়। লালনের গান চারদিকে যতটা ছড়িয়েছিল তার চেয়ে বেশি ছড়িয়েছিল নকল বাউলদের গান। অথচ লালনকে দেখে, তাঁর গান শুনে অনুপ্রাণিত হয়েই দল গড়েছিলেন কাঙাল হরিনাথ।
কাঙালহরিনাথ মজুমদার প্রায় অর্ধশত পুস্তক রচনা করেন। এর মধ্যে ২১ খানা প্রকাশ পায়। বাংলা সাহিত্যের সার্থক উপন্যাস (প্রথম বিজয় বসন্ত তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ)। এ ছাড়া কাব্য গ্রন্থ কোমুদী (১৮৬৬), দ্বদস শিশুর বিবরণ (১৮৬৯), পদ্য পুশুরী (১৮৬২) কাঙাল হরিনাথকে বাঁচিয়ে রেখেছে। কাঙাল হরিনাথ মথুরানাথ যন্ত্র এবং এম এন প্রেস স্থাপন করলেও পত্রিকা প্রকাশে কখনও স্বচ্ছলতা আসেনি, তিনি লিখেছেন গ্রাম বার্তার রজত জয়ন্তীর প্রাক্কালে ৭ টাকা ঋণের দায়ে পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়।
১৬ই এপ্রিল, ১৮৯৬ সালে এই ক্ষণজন্মা লেখক, শিক্ষানুরাগী ও সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব পরলোকগমন করেন। তার মৃত্যুতে ইন্ডিয়ান মিরর পত্রিকা মন্তব্য করেছিল যে, “নদীয়া জেলাবাসী একজন মহান ব্যক্তিত্বকে হারালো”। কুমারখালীবাসি কাঙাল হরিনাথকে বুকের মধ্যে লালন করবে আজীবন।
লেখকঃ
তথ্যসূত্র:-
বাংলা একাডেমী চরিতাভিধান, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, কাঙাল হরিনাথ মজুমদার স্মারকগ্রন্থ, উইকিপিডিয়া।