দীর্ঘদিন ধরে ভাবছিলাম কওমী মাদ্রাসা, হেফজখানা নিয়ে কিছু লিখব। কিন্ত এটা এতটাই সেনসেটিভ ইস্যু যে কিছু বললেই বাস্তবতা কে পাশ কাটিয়ে নাস্তিক বা ইসলামবিরোধী তকমা লেগে যেতে পারে। তাই বহুবার ভেবেও এড়িয়ে গিয়েছি। কিন্ত আজ লিখতেই হবে।
এদেশের শিক্ষাব্যবস্থার ভেতর কওমি মাদ্রাসা এবং হেফজখানা অন্যতম। ইসলামের জ্ঞানে সম্মৃদ্ধ করার জন্য ছোট ছোট বাচ্চাদের ভর্তি করানো হয়৷ সম্ভবত ৮৫ ভাগই দরিদ্র, নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারকেই দ্বীনি শিক্ষায় শিক্ষিত করার বিশেষ উদ্যোগ নিতে দেখা যায়। যারা এ বিষয়ে শিক্ষার উদ্যোগ নেন, মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন তারাও কখনো বিত্তশালী বা সমাজের উচ্চবিত্তের সন্তান কে মাদ্রসায় পড়ানোর জন্য চাপ দেন না। এর পিছনে সামাজিক মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার আছে। সেটা নিয়ে ব্যাখ্যায় যাব না। আমার দেখা কিছু কেস স্টাডি করা যাক।
কেস স্টাডি ১ঃ স্কুল শিক্ষকের সন্তান ফাহিম( ছদ্মনাম) কে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা সমাপ্তের পর কুষ্টিয়া হাউজিং এর একটা মাদ্রাসায় ভর্তি করা হল। সেই মাদ্রাসা লোকালয় থেকে একটু আলাদা জায়গায়। অভিভাবকদের কাছ থেকে মোটা অংক নেওয়া হল যেন সন্তানকে ৩ বেলা ভাল খাবার সরবরাহ করা হয়৷ মাছ মাংশ ডিম দুধ ৩ বেলায় দেওয়া হবে এরকম খাবারের লিস্ট দেখিয়ে মোটা টাকা চায়। সন্তানের ৩ বেলা খাবার এবং ইসলাম শিক্ষায় হাফেজ বানানোর জন্য পিতা খুব কষ্ট করে টাকা পাঠাতেন৷
হঠাৎ মাতৃক্রোড়, গ্রামের দুরন্তপনার শৈশব, বন্ধুদের ছেড়ে দূর শহরে একাকী থাকার যন্ত্রনায় অতিষ্ঠ হয়ে যায় ছেলেটা। খাবার ছিল কোয়ার্টার ডিম ভাজি, হাফ পাঙাস মাছ, আর পাতলা ডাল। তাও ঠিকমতো তিনবেলা জুটত না। একই খাবার রেগুলার৷
একটু চুল বড় হলে মুঠোয় চুল ধরে কাচি দিয়ে কেটে দিত৷ লেখাপড়ায় উন্নতি নেই৷ মারধর ত নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার৷
এদিকে পিতামাতা ছেলেকে হাফেজ বানানোর স্বপ্নে গ্রামে ঘুমায়। ওদিকে ছেলে রাত জেগে কাঁদে৷ নিঃশব্দে, গোপনে। কারন অভিভাবকদের কাছে অভিযোগ করলে অত্যাচার দ্বিগুন হবে।
২ বছরের ছেলের পড়াশোনায় অগ্রগতি নেই৷ স্বাস্থ্য ভেঙে গেছে। অবশেষে দুরন্ত শিশুর শৈশব ভেঙে দিয়ে অভিভাবকরা বাড়িতে নিয়ে আসে। ততদিনে ছেলেটার মনোবল ভেঙে গেছে।
কেস স্টাডিব -২ ঃ দরিদ্র কৃষকের ছেলে সুরুজ। হেফজখানায় পাঠিয়েছিল বাবা। ছেলে মস্তবড় হাফেজ হবেন, ওয়াজ করিবেন, মসজিদে নামাজ পড়াবেন কিন্ত সেই ছেলের পড়াশোনা আর হয় নি। তার পক্ষে পবিত্র কুরআন শরিফ মূখস্ত সম্ভব হয় নি। প্রায়শই পালিয়ে গ্রামে চলে আসত। পিতার মারধোর শেষে হাল ছেড়ে দেয়৷
এরকম অজস্র কেস স্টাডি আছে যেগুলো আমরা চারিপাশে দেখি।
আবার অসংখ্য ছেলে মেয়ে হাফেজ হচ্ছেন, দ্বীনি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশের মাঝে ইসলামি জ্ঞান বিতরণ করছেন।
কিন্ত সঠিক পদ্ধতি, শিক্ষাদান প্রকৃয়া, যথাযথ তদারকি, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের অভাবে ঝরে পড়ছে মাদ্রাসাগামী ছাত্রছাত্রীরা।
সঠিকভাবে মাদ্রাসা শিক্ষার জন্য কিছু নীতিমালা অবশ্যই প্রয়োজন ।
১. সকল কওমি মাদ্রাসায় শারীরিক শাস্তি নিষিদ্ধ করতে হবে।
২. নিয়মিত তদারকি করতে হবে যেন কোন অনৈতিক কাজ না হতে পারে।
৩.শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দিতেই হবে
৪. শিশুর মেধাবিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম রাখতে হবে।
৫. লোকালয়ের বাইরে মাদ্রাসা হেফজখানা স্থাপন করা যাবে না৷ তাতে অনৈতিক কাজ বৃদ্ধি পায়
৬. ইসলামের জ্ঞানের পাশাপাশি বাচ্চাদের আনন্দময় পাঠদানে জন্য অন্যান্য বই সরবরাহ করতে হবে
৭৷ অভিভাবকদের সাথে নিয়মিত মাসিক মিটিং করতে হবে
৮৷ সরকারের পক্ষ থেকে বেতন ভাতা ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় সুবিধা প্রদান করা হোক
৯৷ সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি অন্যান্য জ্ঞানেও সম্মৃদ্ধ করতে হবে।
১০৷ পর্যাপ্ত খেলার মাঠ, উপকরণ থাকতে হবে
১১. পড়াশোনা জন্য নির্দিষ্ট সময় রাখতে হবে৷।
১২. বাচ্চাদের মেধার বিকাশে সর্বোচ্চ সহায়তা ও স্নেহ করতে হবে।
১৩. অনুমোদনহীন যত্রতত্র মাদ্রাসা স্থাপনে বিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে।
আশা করি আমাদের বাংলাদেশে এটা করা সম্ভব হবে। শিশুর শৈশব হোক আনন্দের, বন্ধুত্বের, সম্মানের।
LIFE IS BEAUTIFUL এটা যেন শৈশব থেকেই বুঝতে পারবে ।